দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ বালি উত্তোলনের ফলে ভাঙন দেখা দিয়েছে, চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ধনাগোদা নদীতে। হুমকির মুখে রয়েছে ষাটনল, কালিপুর থেকে কালির বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ কিলোমিটার অঞ্চল। অবৈধ এই বালি উত্তোলনের ফলে কালিপুর বাজার, খাগুরিয়া, হাপানিয়া, নবীপুরসহ পাশ্ববর্তী কয়েকটি অঞ্চলে ধনাগোদা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ভাঙন।
ভাঙ্গনের ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, বেশকয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট বাজার, হাসপাতাল, মসজিদ, মাদ্রাসা, বসতবাড়ীসহ গুরুত্বপূর্ন বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে হুমকির মুখে। পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
এছাড়াও মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বালি উত্তোলনের জন্য ইজারা দিচ্ছে ষাটনল সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে ধনাগোদা নদীর প্রবেশমূখের চরকালিপুরা ও ষোলআনী অঞ্চল। স্থানীয় ষাটনল ও কালিপুর অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ বলছে, এই অঞ্চলগুলো মতলবের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় ষাটনল, কালিপুর, বেলতলীসহ বেশ কিছু অঞ্চলে নদী ভাঙনের ক্ষেত্রে আরো বেশী হুমকির কারন হয়ে দাড়াতে পারে।
গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ধনাগোদা নদী অঞ্চলে অবৈধ বালি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ৪ মাসের ৪টি অভিযানে
১৭টি ড্রেজার, ১১টি বাল্কহেড, ২টি স্পিডবোট ও ২টি ইঞ্জিন চালিত নৌকাসহ ৪০ জনকে আটক করা হয়।
উপজেলার ষাটনল অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদী থেকে শাখা নদী ধনাগোদা মতলব উত্তর ও গজারিয়া উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভাঙন কবলিত ৫ কিলোমিটার অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ৩০ থেকে ৩৫টি ড্রেজার দিয়ে দিনে রাতে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন হয়ে আসছে। প্রায়শই প্রশাসনিক তৎপরতা থাকলে দিনের বেলায় কখনো কখনো বালি উত্তোলন বন্ধ থাকলেও রাতের বেলা সশস্ত্র পাহারায় নদী থাকে প্রভাবশালী বালি উত্তোলনকারীদেরই দখলে। যাদের বিষয়ে কথা বলতে পর্যন্ত ভয় পায় স্থানীয়রা।
এমন কি এই অঞ্চলের অবৈধ বালি কাটার প্রতিবাদে মতলব উত্তর থানার সামনে গত ২৯ ডিসেম্বর সকালে একটি মানববন্ধনের ঘোষণা হলেও, অদৃশ্য প্রভাবে সেই মানববন্ধন হওয়ার আগের রাতে তা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। তবে স্থানীয় দুই টি সংগঠন সেই ডাকে সারা না দিয়ে সাহস করে থানার সামনে এসে মানববন্ধনের প্রস্তুতি নেয়। পরবর্তীতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের আক্রমণে মানববন্ধনে আগতরা আত্মরক্ষায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এসময় গনঅধিকার পরিষদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ইসমাঈল হোসেন ও চাঁদপুর জেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি জিএম মানিকসহ বেশক’জন আহত হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ধনাগোদা নদী পাড়ের স্থানীয় কালিপুর বাজার, বেলতলী বাজার ও কালির বাজারে কয়েকজন ব্যবসায়ী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এই নদীর ট্রলার চালক সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই নদীতে অবৈধ বালি উত্তোলনের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২২ অক্টোবর মঙ্গলবার সকালে অবৈধ বালি উত্তোলনকারী ও নৌ ডাকাত সরদার বাবলা বাহিনীর প্রধান বাবলা (৪২)কে ফিল্মি স্টাইলে খুন করা হয়। ফলে এই অঞ্চলের অবৈধ বালি উত্তোলন এখন বাবলা বাহিনীর প্রধান বাবলা হত্যা মামলার আসামি নয়ন ও রিপন বাহিনীর শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
কালিপুর বাজার সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন জানান, নদীর আচমকা ভাঙনের ফলে বাজারের ব্যবসায়ী, স্থানীয় বসতী, কালিপুর স্কুল এন্ড কলেজ, কালিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের, কালিপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ফয়েজ আহম্মেদ মেমোরিয়াল হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হঠাৎ করেই এত তীব্র ভাঙন হবে যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। এই অঞ্চলের মানুষ এখন আতঙ্কের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছে।
এ বিষয়ে মেঘনা ধনাগোদা পানি ফেডারেশনের সভাপতি রাসেল ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী শহীন জানান, এই ধনাগোদা নদীতে অবৈধ বালি উত্তোলনের কারনে দেশের ২য় বৃহৎ ধনাগোদা সেচ প্রকল্প আজ হুমকির মুখে। ধনাগোদা সেচ প্রকল্প নিকটস্থ ধনাগোদা নদীর তীরবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে বাড়ী ঘর ও ফসলী জমি।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের (পাউবো’র) নির্বাহী প্রকৌশলীর মো. সেলিম শাহেদ বলেন, ধনাগোদা নদীর কালিপুর, খাগুরিয়া, হাপানিয়া, নবীপুরসহ কয়েকটি অঞ্চলে ভাঙ্গন দেখা দিলে আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেই। তবে নদীর তীর ও সেচ প্রকল্প বাঁধ রক্ষায় ধনাগোদা নদীতে অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধের বিষয়ে আমরা সহসাই লিখিত অভিযোগ জানাবো।
এ বিষয়ে মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা কুলসুম মণি বলেন, ধনাগোদা নদীতে অবৈধ বালু কাটার বিরুদ্ধে আমরা অভিযান চালিয়েছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
ভাঙনকবলিত এলাকা ষাটনল ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদাউস আলম জানান, এই ধনাগোদা নদীতে অবৈধ বালি উত্তোলনের কারনে ষাটনল ইউনিয়নের ষাটনল, কালিপুর সহ কয়েকটি অঞ্চল ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। তাই পাশ্ববর্তী এলাকায় বালি মহলের নামে ইজারা দেওয়া মতলবের জন্য হুমকির ও আতংকের কারণ। খাগুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মিয়া মঞ্জুর আমীন স্বপন জানান, ধনাগোদা নদীর ভাঙনে খাগুরিয়া, হাপানিয়া ও নবীপুর এলাকার অনেক পরিবার ইতিমধ্যে জমি হারিয়ে পথে বসেছে। কখন যে নদী ভেঙে আমাদের ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ, হাট বাজার, ফসলী জমিসহ নদীতে বিলীন হয়ে যায় এনিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। এমনকি মেঘনা ধনাগাদা বেড়ী বাঁধটিও ঝুঁকিতে রয়েছে।